Tuesday, June 7, 2016

স্তন ক্যানসার কীভাবে পরীক্ষা করবেন?

স্তন ক্যানসার কীভাবে পরীক্ষা করবেন?
ডা. হুমায়ুন কবীর হিমু


মিটফোর্ড হাসপাতালের সার্জারি বিভাগে ভর্তি আলেয়া বেগম। বয়স ২৮ বছর। স্বামী একটি দোকানে সেলসম্যান হিসেবে কাজ করেন। সংসারে চার বছরের ছেলেসন্তান আছে। গত বছর স্তনে ব্যথা ও চাকার মতো কিছু একটা অনুভব করলে মিটফোর্ডে বহির্বিভাগে চিকিৎসককে দেখালে সার্জারি ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসক পরীক্ষা করে জানান স্তনে টিউমার হয়েছে তাঁর।
টিউমারের আকার বড় হওয়ায় অপারেশনের আগে রেডিওথেরাপি দিতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন ২০ হাজার টাকা। সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। স্বামী অনেক চেষ্টা করেও টাকা সংগ্রহ করতে না পারায় আবার টিউমারটি তেমন সমস্যা করে না বলে চিকিৎসা না করিয়েই ফিরে যান তিনি। ভেবেছিলেন সমস্যাটি আপনাআপনি ভালো হবে। তবে সমস্যা ভালো হয়নি। এক বছরের মধ্যে ক্যানসার সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ে। এখন তাঁর শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। সারা স্তনে ঘা দগদগ করছে। আবার ভর্তি হলেন হাসপাতালে। এবার স্বামী টাকা জোগাড় করতে পারলেও চিকিৎসা হচ্ছে না তাঁর।

চিকিৎসক জানিয়েছেন, ক্যানসার সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ায় কেমোথেরাপি বা রেডিওথেরাপি দিয়েও লাভ হবে না। প্যালিয়েটিভ চিকিৎসা হিসেবে তাঁর আক্রান্ত স্তনে অপারেশন করা হলেও কোনোদিন সুস্থ হবেন না আলেয়া বেগম। এখন চোখের জলই তাঁর সম্বল। হাসপাতালে চিকিৎসক কাউকে দেখলেই কেঁদে কেঁদে বলছেন, ‘স্যার আমাকে বাঁচান। আমি মারা গেলে আমার ছেলেকে কে দেখবে? আমার ছেলে আমাকে ছাড়া কিছুই বোঝে না। গত বছর মাত্র ২০ হাজার টাকার জন্য চিকিৎসা করাতে পারি নাই। এখন জমি বিক্রি করে টাকা এনেছি স্যার, আমাকে বাঁচান। আমি এত তাড়াতাড়ি মরতে চাই না।’ তাঁর এ কান্না চিকিৎসকেও বিচলিত করে তোলে। কিন্তু কিছুই করার নেই। আলেয়া আজ মৃত্যুর প্রহর গুনছেন।

এভাবেই আমাদের কারো মা, বোন, স্ত্রী স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন, হারিয়ে গেছেন অনেকেই। সারা বিশ্বে ২০০৪ সালে এ ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে পাঁচ লাখ ১৯ হাজার নারী মৃত্যুবরণ করেন। আমেরিকার মতো উন্নত দেশে প্রতিবছর দুই লাখ ১৬ হাজার নারী স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ৪০ হাজার নারী মারা যান।

বাংলাদেশেও ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা কিন্তু কম নয়। আলেয়ার মতো অসচেতনতাই এর মূল কারণ। একটু সচেতন হলেই আমরা রক্ষা করতে পারি আমাদের প্রিয় মুখগুলোকে।

স্তন ক্যানসার নির্ণয়ের গুরুত্ব

স্তন ক্যানসার নারীর জন্য মূর্তমান আতঙ্ক হলেও এটি অনেক ক্যানসারের তুলনায় ভালো। যেমন, অগ্ন্যাশয়ের ক্যানসারের কথাই ধরা যাক, এটা এমনই মারাত্মক ক্যানসার যে এটা বোঝার কোনো উপায়ই থাকে না। একেবারে শেষের দিকে এটি ধরা পড়ে। আর যখন ধরা পড়ে, তখন করার কিছুই থাকে না। অথচ একটু সচেতন হলেই এ ক্যানসার থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। আবার এ ক্যানসারে আক্রান্ত হলেও যদি ক্যানসারের শুরুতে রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসা করা সম্ভব হয়, তাহলে পুরোপুরি সুস্থ মানুষের মতো জীবনযাপন করা সম্ভব। সঠিক সময়ে ও সঠিকভাবে স্তন ক্যানসারের চিকিৎসা করানো সম্ভব হলে রোগমুক্ত হয়ে ১০ বছর বেঁচে থাকার হার প্রায় ৯৮ শতাংশ। এ ক্যানসার নির্ণয় করার জন্য বেশ কিছু ভালো পদ্ধতি আছে।

একটি কথা মনে রাখতে হবে, স্তন ক্যানসার শুরুতে নির্ণয় করে চিকিৎসা করাতে পারলে যেমন প্রাণে বাঁচা সম্ভব হয়, তেমনি এ ক্যানসার বেশি দিন ধরে নির্ণয় করা না হলে বা চিকিৎসা করা না হলে রোগীর মৃত্যু অবধারিত।

ক্যানসারের শুরুতেই নির্ণয় করুন নিজে নিজেই

স্তন ক্যানসার নির্ণয়ে আপনি একজন চিকিৎসকের ভূমিকা পালন করতে পারেন। এ জন্য মাসে আপনাকে কয়েক মিনিট সময় ব্যয় করতে হবে। নিজে নিজে আপনার স্তন পরীক্ষা করুন। মাসিক শুরুর ৭-১০ দিন পর বা মাসিক শেষ হওয়ার তিনদিন পর স্তন পরীক্ষা করা সবচেয়ে ভালো সময়। এ সময় স্তনের তরল কমে যায় ও কোষের বৃদ্ধি কমে যাওয়ায় স্তনে কোনো ধরনের সমস্যা দেখা দিলে তা ভালোভাবে বোঝা যায়।

শরীরের ওপরের অংশ থেকে পোশাক খুলে দুই হাত পাশে রেখে আয়নার সামনে বসুন। এবার ভালোভাবে লক্ষ করুন স্তনে কোনো অস্বাভাবিকতা যেমন, দুটো স্তনের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য আছে কি না, স্তনের আকার আকৃতি ও রঙের পরিবর্তন, দুটো নিপল বা স্তন বোঁটা একই রেখায় বা সমতলে আছে কি না, বোঁটা ভেতরের ঢুকে গেছে কি না, স্তনের ত্বকে কোনো পরিবর্তন দেখা যায় কি না, বোঁটা থেকে পানির মতো কিছু বেরুচ্ছে কি না। এবার হাত আস্তে আস্তে মাথার ওপরে তুলুন। দেখুন স্তনের ত্বক কমলালেবুর খোসার মতো মনে হচ্ছে কি না। কোকো চাকা দেখা যায় কি না।

এবার সমস্ত স্তনকে চার ভাগ করে প্রত্যেক ভাগ হাতের আঙুল দিয়ে ভালো করে পরীক্ষা করুন। হাতে চাকার মতো কিছু লাগে কি না তা বোঝার চেষ্টা করুন। যদি স্তনে কোনো চাকা বা ওপরের সমস্যাগুলো দেখা যায় তাহলে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যান। এভাবে প্রতি মাসে একবার স্তন নিজে নিজে পরীক্ষা করুন।

গবেষণায় দেখা গেছে, শুধু এ পরীক্ষার মাধ্যমেই স্তন ক্যানসার শুরুতে নির্ণয় করার মাধ্যমে অনেকের জীবন রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে। গবেষকরা বলেছেন, ২০ বছরের সব নারীকে মাসে অন্তত একবার নিজের স্তন নিজেই পরীক্ষা করতে হবে। ৪০ বছরের বেশি বয়সীদের ক্ষেত্রে বছরে অন্তত একবার চিকিৎসকের মাধ্যমে স্তন পরীক্ষা করাতে হবে। আর ৪০ বছরের কম বয়সীদের তিন বছরে একবার চিকিৎসকের মাধ্যমে স্তন পরীক্ষা করাতে হবে। এ ছাড়া ম্যামোগ্রামের মাধ্যমে নির্ণয় করা যেতে পারে স্তনের ক্যানসার। ম্যামোগ্রাম হলো স্তনের এক্সরে। হাতের সাহায্যে স্তনের খুব ছোট চাকা নির্ণয় করা না গেলেও এর মাধ্যমে তা নির্ণয় করা যায়। শতকরা ৮৫-৯০ ভাগ স্তন ক্যানসার এ পরীক্ষার মাধ্যমে নির্ণয় করা হয়।

ম্যামোগ্রাফির মাধ্যমে স্তন ক্যানসার শুরুতে নির্ণয় করায় মহিলাদের স্তন ক্যানসারে মৃত্যুর হার কমেছে ২০-৩০ ভাগ। আমেরিকান ক্যানসার সোসাইটির মতে, প্রত্যেক নারীকে ৪০ বছর বয়সে একবার ম্যামোগ্রাম করা প্রয়োজন। এর পর থেকে প্রতিবছর একবার করে এ পরীক্ষার করার ব্যাপারে তারা সুপারিশ করেছে।

যদি কারো ক্যানসারের লক্ষণ বা ঝুঁকি থাকে; যেমন কারো মা, বোনের ক্যানসার ধরা পড়ে তাঁদের ৩৫ বছর বয়সে প্রথমবার ম্যামোগ্রাফি করাতে হবে। এর পর থেকে বছরে একবার করে এ পরীক্ষা করতে হবে। তরুণীদের স্তনে ঘন স্তন টিস্যু থাকার কারণে ম্যামোগ্রাফির মাধ্যমে ক্যানসার নির্ণয় করা যায় না। এ ক্ষেত্রে ক্যানসার ঘন স্তনের মধ্যে ঢাকা পড়ে। তরুণীদের হতাশ হওয়ার কারণ নেই তাদের ক্যানসার যদি হয়েও থাকে তা শুরুতে নির্ণয় করা যায় ব্রেস্ট আলট্রাসনোগ্রামের মাধ্যমে। এ ছাড়া আছে এমআরআই। এটি সবচেয়ে আধুনিক পরীক্ষা। অনেকে মনে করেন ম্যামোগ্রাম এক্সরে পরীক্ষা বলে তা বারবার করালে ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ায়।

গবেষণায় বিজ্ঞানীরা দেখতে পেয়েছেন যে, ম্যামোগ্রাম করালে কোনো প্রকার ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ে না। তাই এটা নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কারণ নেই।

সংকোচ করবেন না

অনেকেই স্তনে কোনো রোগ হলেও সংকোচে চিকিৎসকের কাছে যেতে চান না। ফলে ধীরে ধীরে রোগ জটিল আকার ধারণ করতে শুরু করে। এমনও দেখা যায় যে, শুধু সংকোচের কারণেই ক্যানসার জটিল আকার ধারণ করে মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই সংকোচ করবেন না। স্তনে কোনো ধরনের অস্বাভাবিকতা দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

চিকিৎসা

স্তন ক্যানসারের বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা ব্যবস্থা আছে। চিকিৎসা পদ্ধতির মধ্যে আছে ম্যাসটেকটমি ও রিকনস্ট্রাকশন। এ অপারেশনে আক্রান্ত স্তন কেটে ফেলে নতুন করে স্তন তৈরি করে দেওয়া হয়। আরো আছে রেডিওথেরাপি, কেমোথেরাপি, হরমোন থেরাপি। চিকিৎসক রোগীর অবস্থা দেখে চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ণয় করেন। যে কথাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ তা হলো ক্যানসার শুরুতে চিকিৎসা করালে যেমন ভালো ফল পাওয়া যায়, ক্যানসার দেহে ছড়িয়ে পড়লে আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসায় ভালো ফল পাওয়া সম্ভব নাও হতে পারে।

লেখক : মেডিকেল অফিসার, ঢাকা মেডিকেল কলেজ

No comments:

Post a Comment